আত্মহত্যা করা সেই যুবককে কাল্পনিক প্রেমিকার খোলা চিঠি

ফিচার ডেস্ক •

আমার ফুলশয্যার রাত শেষ হতে না হতেই তোমার মৃত্যুর খবর এলো। ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছ তুমি। তোমার ছবি পোস্ট করে সবাই লিখছে- প্রেমিকার অন্যত্র বি‌য়ে হওয়ায় নিজেকে শেষ করে দিলেন ঢাবি শিক্ষার্থী। সেইসব পোস্টের কমেন্টে অনেক অচেনা মানুষ সারি বেঁধে আমাকে গালি দিচ্ছে। লোভী বলছে, প্রশ্ন তুলছে আমার চরিত্র নিয়ে। তাতে দুঃখ পাচ্ছি না। কিন্তু চিন্তা হচ্ছে, তোমার এই আত্মহত্যা আমাকে কেন ছুঁয়ে যাচ্ছে না?

সবাই বলছে, তুমি নাকি আমাকে এত বেশি ভালোবেসেছিলে যে, হারানোর ব্যথা সইতে পারনি। আমি বলি- তুমি কেমন পুরুষ শুনি? আমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেছিলে বছর দুইয়ের বেশি না। সেই আশা ভেঙে যেতেই তোমাকে একুশ বছর ধরে আগলে রাখা মা-বাবার ভালোবাসা দুপায়ে মাড়িয়ে স্বার্থপরের মতো চলে যাও। একুশ বছরের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মূল্য যে মানুষ দিতে জানে না, সে আজীবন আমায় মূল্য দেবে, ভালোবেসে আগলে রাখবে সেই বিশ্বাস কীভাবে করি? ঠান্ডা মাথায় ভেবে বলতো, তোমার এই আত্মহত্যা একজন প্রেমিকের আত্মহত্যা নাকি একজন স্বার্থপরের?

তুমি প্রেমিক হলে, ভালোবাসতে জানলে বুঝতে, জগৎ শুধুই স্বার্থপরের মতো ব্যক্তিগত হাসি-কান্না, চাওয়া-পাওয়া পূরণের ক্রীড়ালোক নয়। তোমার জীবন মানে শুধুই তোমার নয়। সেটি তোমার বাবা-মা, ভাইবোন, প্রতিবেশীরও। তোমার জীবনের ঋণ আছে তোমার পাড়া-মহল্লা, গ্রামের কাছে। ঋণ আছে তোমার দেশ আর দেশবাসীর কাছেও। তোমার যখন জ্বর হয়েছে বাবা-মা ডাক্তারের কাছে ছুটেছেন। হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। ডাক্তারের চিকিৎসায়, নার্সের সেবায় তুমি সুস্থ হয়েছ। বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিয়েছ। নদীর পারে গোধূলির আলোয় মুগ্ধ হয়েছ আমাকে দেখে। তোমার ঋণ আছে এই রোদের কাছে। নদীর ঢেউ, শীতল বাতাসের কাছে। দায় আছে ডাক্তার-নার্স আর ইট পাথরের হাসপাতাল বানানো রাষ্ট্রের কাছে। এই দেশের কৃষক, জেলে, রিকশাওয়ালা বৃদ্ধের কাছেও তুমি ঋণী। যাদের ঘাম ঝরানো টাকার ভ্যাট-ট্যাক্সে রাষ্ট্র তোমার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন দিয়েছে। ডাক্তার-নার্স, হাসপাতাল গড়েছে সেবা দিতে।

এইসব ঋণ, এতসব দায়-দেনা অস্বীকার করে তুমি যখন অবিবেচকের মতো বিষের বোতল হাতে তুলে নাও, তখন নিজের অজান্তেই প্রমাণ করে দাও তুমি একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন আত্মকেন্দ্রিক তুচ্ছ মানুষ।

তুমি সেই নৈরাশ্যবাদী ভেঙে পড়া নাবিকের মতো, যার না আছে লড়াই করার ইচ্ছা; না আছে দূরদৃষ্টি। বস্তুত তুমি অকৃতজ্ঞ এক পলকা হাওয়ার মতো। যার আত্মসম্মান বলে কিছু নেই। আত্মসম্মান বোধ থাকলে কেউ এভাবে নিজেকে খুন করে অসম্মান করতে পারে না। তাই, আমাকে না পেয়ে কেউ একজন আত্মখুনি হয়েছে- এমন খবরে না আমার শোক হয়, না অনুশোচনা। তোমার জন্য যা হয় তাকে সবাই করুণা ও অনুকম্পা বলেই জানে।

এইসব যদিও বলছি তবু দিন শেষে মানুষের অনুভূতিকে অস্বীকার করা যায় না। তাই তোমার মতো আত্মবিশ্বাসহীন জীবিতদের বলতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসা মানে শুধু পাশাপাশি থাকা নয়। অনিবার্যভাবে পাওয়া নয়। সেই ইচ্ছা মূলত দখলদার মনের প্রাগৈতিহাসিক বাসনা। প্রকৃত ভালোবাসা তাই, যা নির্মল আলোর মতো। বিমল বাতাসের মতো। যা মুক্তি ও প্রশান্তির স্বাদ এনে দেয়। কে আমাকে ভালোবাসে, কে আমাকে বাসে না- তাতে কী-ইবা আসে যায়? আমি যে ভালোবাসতে পারি, বেসে পরাণে আনন্দ লাভ করি সেই আমার আসল পাওয়া। জীবনের বাঁকে বাঁকে কত প্রতিকূলতা। কত যুদ্ধ। কত আলো-আধার, দ্রোহের গান। এখানে স্বার্থপরতা ও হতাশার সুযোগ কোথায়?

(কাল্পনিক এই চিঠিটি লিখেছেন হাসনাত কাদীর)

লেখক ও সংবাদকর্মী